
মোঃ সিরাজুল মনির চট্টগ্রাম ব্যুরো
রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অচলাবস্থার কারণে ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়ে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হলেও ‘কৌশলে’ আবার পালিয়ে যাচ্ছেন। ভাসানচর থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, ‘ভাসানচরে কাজ নেই। অভাবের কারণে দালালের সহায়তায় ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারি ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার এবং ভাসানচরে ১১ লাখ ৬২ হাজার ৯৩৯ জন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছেন। এর মধ্যে ভাসানচরে অবস্থান করছেন ৩৭ হাজার ৫৬ জন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিলেন।
সীমিত পুনর্বাসন: পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার ৪৯৪ শরণার্থীর প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। ২০২১ থেকে ২০২৫ সালে বিভিন্ন দেশে এসব শরণার্থীর পুনর্বাসন করা হয়। নিজ দেশে (মিয়ানমার) প্রত্যাবাসন আটকে থাকায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জন্মহার বেড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে। প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার নতুন শিশু জন্ম নিচ্ছে। বেসরকারি হিসাবে আট বছরে কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে ১৩ লাখে দাঁড়িয়েছে। তবে ইউএনএইচসিআর’র তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১১ লাখ ৬২ হাজার ৯৩৯ জন রোহিঙ্গা রয়েছে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ শামছুদ্দোজা জানান, ২০১৭ সালে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যার পরিমাপটি ভুল ছিল। পরবর্তীতে ইউএনএইচসিআর নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃত সংখ্যা অনেক কমে আসে। জন্মহারের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এবং জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি বাংলাদেশের ওপর চাপ বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের ওপর আস্থা রাখছে। কারণ ১১ লক্ষাধিক মানুষের স্থায়ী সমাধান দিতে অক্ষম। তবে প্রত্যাবাসন না হওয়ায় চ্যালেঞ্জগুলো এখন কেবল মানবিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশে ছোট্ট একটি ভূখণ্ডে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে দীর্ঘকাল ধরে রাখায় সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, হত্যাকাণ্ড, বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা, সীমান্তে মাদক চোরাচালান ও মানবপাচার বৃদ্ধির বিষয় প্রমাণ করে, এই পরিস্থিতি এখন আর শুধু উখিয়া, টেকনাফ বা কক্সবাজারে সীমাবদ্ধ নেই; এটি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রসবর্ডার ক্রাইম সংগঠিত হচ্ছে।
দালালচক্রের সহায়তায় ভাসানচর থেকে পালাচ্ছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা: ভাসানচর থেকে দালালচক্রের মাধ্যমে কৌশলে পালিয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে চর থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়ছেন। তবে ধরা না পড়ার চেয়ে বের হয়ে পালিয়ে যাওয়া সংখ্যা অনেক বেশি বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ২৯ জুন সকালে সন্দ্বীপের মুছাপুর উপকূলে একটি বিকল ট্রলার থেকে ২১ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে ১৭ জন পুরুষ, একজন নারী ও তিনটি শিশু ছিল। তাদের ভাষ্যমতে, ভাসানচরে কাজের অভাব রয়েছে। কাজের খোঁজে এবং পরিবার-পরিজনের সঙ্গে দেখাশোনার জন্য চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশ্যে ট্রলারে উঠেছিলেন। এর আগে মে মাসে আরও ৪৫ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে পুলিশ আটক করেছিল। ২০২৪ সালের অক্টোবরে তিন রোহিঙ্গা যুবক সন্দ্বীপে ধরা পড়েছিলেন। তাদের সবাই ভাসানচর থেকে নৌপথে পালিয়ে আসার কথা স্বীকার করেন। পুলিশের ভাষ্য, দালালের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কর্মসংস্থানের খোঁজে ছড়িয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। আবার অনেকেই কক্সবাজার ও টেকনাফে পরিবার-পরিজনের কাছে ছুটে যাচ্ছেন।
কেন পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক রোহিঙ্গাদের স্বীকারোক্তি ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন মতে, ভাসানচরের বিচ্ছিন্ন জীবন, কর্মসংস্থানের অভাব, চলাচলে কড়াকড়ির কারণে স্থায়ীভাবে থাকতে ছাইছেন না রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। আটক এক রোহিঙ্গা জানান, ‘ভাসানচরে কোন কাজ নেই। পরিবার থাকে কক্সবাজারে। দেখা করতে পারি না। তাই দালালের মাধ্যমে কক্সবাজারে ফিরে যাচ্ছিলাম।
আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ কয়েকটি সংস্থা জানিয়েছে, ভাসানচরের জীবনযাত্রা এখনও ‘সীমিত স্বাধীনতা ও সুযোগহীনতা’র মধ্যে আবদ্ধ। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও যোগাযোগব্যবস্থার ঘাটতির কারণে অনেক রোহিঙ্গা হতাশ হয়ে পড়ছেন।
সক্রিয় পাচারকারী ও দালাল: বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের পালানোর পেছনে সক্রিয় রয়েছে একাধিক দালাল ও নৌচালক চক্র। তারা ভাসানচর থেকে ট্রলার ভাড়া করে সন্দ্বীপ বা হাতিয়া উপকূলে পৌঁছে দিচ্ছে। এজন্য প্রতিজনের কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। তবে চুক্তিমতো টাকা পরিশোধ করতে না পারলে রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে রাখে দালালচক্র। টাকা না দিলে তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন, নারীদের যৌন নিপীড়ন ও নৌকায় আটকে মারধরও করা হয়।
সন্দ্বীপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম সফিকুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আটক রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে ফের ভাসানচরে ফেরত পাঠানো হয়।
নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড সূত্র জানায়, ভাসানচর থেকে পালানোর রুটগুলো নজরদারিতে রয়েছে। রাতে নৌচলাচল বন্ধ, সন্দেহজনক ট্রলার তল্লাশি করা হচ্ছে।
সরকারি হিসাবে, ভাসানচরে ৩৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। দ্বীপটিকে ‘পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প’ হিসেবে গড়ে তোলা হলেও সীমিত সুযোগ-সুবিধা ও জীবিকার অনিশ্চয়তার কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর প্রবণতা বাড়ছে বলে জানায় মানবাধিকার সংস্থা।