মোঃ সিরাজুল মনির চট্টগ্রাম ব্যুরো
ইছহাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিং–এর বিপরীতে ২৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা পৌরকর (গৃহকর ও অন্যান্য রেইট) নির্ধারণ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন এসেসর (পৌরকর মূল্যায়নকারী)। কিন্তু আপিল রিভিউ বোর্ডে উপস্থাপনের সময় ওই পৌরকরের ‘ফিল্ড বুক’ থেকে ‘২’ মুছে দেয়া হয়। অর্থাৎ ঘষামাজা করে ২০ কোটি টাকা কমিয়ে উপস্থাপন করা হয় ৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা। এ ‘অনিয়ম’ করেছেন সংস্থাটির একজন কর–কর্মকর্তা ও উপ–কর কর্মকর্তা। দায়িত্ব অবহেলা করেছেন এক হিসাব সহকারী। এতে যোগসাজশ রয়েছে হোল্ডিং মালিকেরও।
চসিকের একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। দীর্ঘ ১০ মাস অনুসন্ধান শেষে প্রণীত তদন্ত প্রতিবেদনটি গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাদা ফ্লুইড ব্যবহার এবং ঘষামাজা করে প্রকৃত বার্ষিক মূল্যায়ন পরিবর্তন করে ২০ কোটি টাকা কমিয়ে দেয়া হয়। এ জন্য কর–কর্মকর্তা নুরুল আলম এবং উপ–কর কর্মকর্তা জয় প্রকাশ সেন জড়িত। এছাড়া হিসাব সহকারি আহসান উল্লাহ্ তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি। তবে তিনি কর কর্মকর্তা ও উপ–কর কর্মকর্তার কথা মত কাজ করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। যেভাবে তদন্তে এসেছে সেভাবেই দোষী কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মেয়র বলেন, আগের মেয়রদের আমলে এ অনিয়ম হয়েছে। আমি চাই, কর্পোরেশনে স্বচ্ছতা বিরাজ করুক। দুর্নীতিমুক্ত হোক কর্পোরেশন।
যে প্রক্রিয়ায় তদন্ত কমিটি গঠন : চসিকের রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পৌরকর নির্ধারণের বার্ষিক মূল্যায়নটি হয়েছে ২০১৭–২০১৮ অর্থবছরে। আপিল রিভিউ বোর্ডের শুনানি হয়েছে ২০২১ সালের ১৩ জুন। পরবর্তীতে অডিটে বিষয়টি ধরা পড়লেও আমলে নেননি চসিকের তৎকালীন মেয়রসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ডা. শাহাদাত হোসেন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ঘষামাজা করে প্রকৃত বার্ষিক মূল্যায়ন পরিবর্তন করার বিষয়ে প্রকৃত অপরাধী সনাক্ত করার জন্য নির্দেশনা দেন।
এর প্রেক্ষিতে গত ১৩ জানুয়ারি ৪ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। ৩১ জানুয়ারি আকার বৃদ্ধি করে পাঁচ সদস্যে উন্নীত করা হয়। চসিকের আইন কর্মকর্তা মহিউদিন মুরাদকে আহ্বায়ক ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে গঠিত এ তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন– নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৈতী সর্ববিদ্যা, শিক্ষা কর্মকর্তা রাশেদা আক্তার ও ৮নং রাজস্ব সার্কেলের কর কর্মকর্তা আব্দুল মাজিদ।
আর্থিক ক্ষতি হয়েছে চসিকের : তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, চসিকের ৮নং রাজস্ব সার্কেলের আওতাভুক্ত দক্ষিণ পতেঙ্গা মহল্লার ফিল্ড বই ২ এর ১০০ পৃষ্ঠায় হোল্ডিং নং ৫১৫/৩/৫৯৪ এবং দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর মহল্লার ফিল্ড বই ২ এর ১০ পৃষ্ঠার হোল্ডিং নং ৩১৮/৩৩১ এর বার্ষিক মূল্যায়নের ফিল্ডবুকে ঘষামাজা করার বিষয়টি একটি ষড়যন্ত্রমূলক কাজ। যা কর্পোরেশনকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এতে জড়িতরা নিজেরা অনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে এ কাজ করে। এ ধরনের ষড়যন্ত্র অতি গোপনে করা হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এর কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া সম্ভব নয়। শুধুমাত্র জড়িত ব্যক্তিরায় এ বিষয়ে অবগত থাকেন। যে কারণে ঘটনা সংঘটনের সময় পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সংশ্লিষ্ট সার্কেলে কর্মরত কর্মকর্তা–কর্মচারিগণের কার্যপরিধি বা দাপ্তরিক দায়িত্ব এবং তাদের লিখিত বক্তব্য ও মৌখিক জবানবন্দী বিবেচনায় তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়।
যোগসাজশ রয়েছে ইছহাক ব্রাদার্সেরও : তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, হোল্ডিং মালিকও জড়িত। কারণ তারা এই অপরাধের বেনিফিশিয়ারি (সুবিধাভোগী)। পুরো ঘটনায় হোল্ডিং মালিকের যোগসাজশ রয়েছে। তাদের কারণে সিটি কর্পোরেশন বিপুল রাজস্ব বঞ্চিত হয়ে আসছে। পূর্বের রিভিউ বোর্ডের সিদ্বান্ত বাতিল করে প্রকৃত মূল্যায়ন অর্থাৎ ২৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকার উপর ভিত্তি করে আপিল রিভিউ বোর্ডে শুনানি করা যেতে পারে বলেও সিদ্ধান্ত দেয় তদন্ত কমিটি।
যেভাবে সংঘটিত হয় ‘অনিয়ম’ : প্রতিবেদনে বলা হয়, হোল্ডিংগুলো ইছহাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের। এসেসমেন্ট করেছেন বর্তমানে ৪ নং সার্কেলে কর কর্মকর্তা (লাইসেন্স) হিসেবে কর্মরত দবীর আলম চৌধুরী। পাবলিশড কপিতেও একই বার্ষিক মূল্যায়ন লেখা হয়।
জানা গেছে, ফিল্ড বুক এবং পাবলিশড কপি চসিকের প্রধান কার্যালয়ে জমা দেওয়ার পর সার্কেল অফিসে পাঠানো হয়। ফিল্ড বুক দেখে ট্যাঙ পেয়ার লেজার এবং কর নিরুপণ তালিকা প্রস্তুত এবং হালনাগাদ করা হয়। ইছহাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ট্যাঙ পেয়ার লেজার এবং কর নিরুপণ তালিকায় কোনো ধরনের ঘষামাজা নেই। তবে তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট হোল্ডিংয়ের এসেসমেন্ট লিস্ট (করনিরুপণ তালিকা) পর্যালোচনায় দেখতে পায়, ৩১৮/৩৩১ নং হোল্ডিংয়ের বিপরীতে বার্ষিক মূল্যায়ন লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা। ট্যাঙ পেয়ার লেজারের সংশোধিত মূল্যায়নেও একই অংক লেখা হয়। তবে এবং চূড়ান্ত মূল্যায়ন লেখা হয়েছে ২ কোটি টাকা। এখানে ট্যাঙ পেয়ার লেজার এবং কর নিরুপণ তালিকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সংশোধিত মূল্যায়ন তথ্য একইদিন ( ২০২১ সালের ১৩ জুন) লিপিবদ্ধ করা হয়। আবার ইছাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের রিভিউ বোর্ডের শুনানিও অনুষ্ঠিত হয়ে ২০২১ সালের ১৩ জুন। অর্থাৎ রিভিউ বোর্ডের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরেই ট্যাঙ পেয়ার লেজার এবং কর নিরুপণ তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে।
জানা গেছে, রিভিউ বোর্ডে আপিল শুনানির পূর্বেই প্রদত্ত তথ্যের সঠিকতার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাজস্ব সার্কেল কর্তৃক সার্টিফিকেট প্রদান করতে হয়। কিন্তু এখানে কোনো সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়নি।
জোর করে নেয়া হয় স্বাক্ষর : তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, আপিল ফরমের ‘ফিল্ড বই এর সাথে আবেদিত ফরমের তথ্য সঠিক আছে’ একটা লেখা রয়েছে। যার নিচে আছে দুটি স্বাক্ষর। এ বিষয়ে আহছান উল্লাহ্ কমিটিকে দেয়া জবানবন্দীতে বলেছেন, একটি স্বাক্ষর তার এবং অন্যটি জয় প্রকাশ সেনের। তিনি ফিল্ড বুক না দেখে নুরুল আলম ও জয় প্রকাশ সেনের কথা মত স্বাক্ষর করেন। এক্ষেত্রে তাকে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। ফিল্ড বুক ও কর–কর্মকর্তা ও উপ–কর কর্মকর্তার হেফাজতে থাকত।
তবে এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি মনে করে, ফিল্ড বুক দেখে আপিল ফরমের তথ্য যাচাই করে প্রত্যায়ন করার কথা থাকলেও আহসান উল্লাহ্ আইন অমান্য করেছেন।
দায় এড়ানোর চেষ্টা : জয় প্রকাশ সেন দাবি করেন, ফিল্ড বই, পাবলিশড কপি, ট্যাঙ লেজার, এসেসমেন্ট লিস্ট তার কাছে ছিল না। সেগুলো উচ্চমান সহকারি বা সহকারির কাছে ছিল। আপিল বোর্ডের শুনানিতে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তিনি কোনো ডকুমেন্ট ঘষামাজা করেন নি।
তদন্ত কমিটিকে দেয়া জবানবন্দীতে তিনি বলেন, ‘ইছাক ব্রাদার্সের ফিল্ড বুক সম্ভবত ২৬ কোটি টাকা ছিল। আপিল ফরম যাচাই করার সময় ফিল্ড বুকে কাটাছেঁড়া বা ঘষামাজা ছিল। তিনি নুরুল আলমকে আপিলটি বোর্ডে উপস্থাপন না করার জন্য বলেন বলেও দাবি করেন জবানবন্দীতে। তবে নুরুল আলম তাকে বলেন, ‘এটা তোমার দেখার বিষয় না, ফিল্ড বুকে যা আছে তা লেখ। সমস্যা নাই মেয়র সাহেব বিষয়টি দেখবে’। জয় সেনের দাবি, তিনি আপিল বোর্ডের শুনানিতে ছিলেন না। নুরুল আলম, চসিকের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন এবং ইছাক ব্রাদার্সের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
তবে নুরুল আলম তার জবানবন্দীতে দাবি করেন, তিনি আপিল ফরমে কোনো ঘষামাজা দেখেননি। রিভিউ বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন। ২৫/২৬ কোটি টাকা মূল্যমানের প্রায় ১০টি হোল্ডিং আছে ৮নং সার্কেলে। এই ৮/১০টি হোল্ডিং সবার নলেজে আছে। তবে ইছহাক ব্রাদার্স এবং ইনকন ট্রেড লিমিটেডের ঘষামাজার বিষয়টি তার নলেজে নাই। ৮নং সার্কেল থেকে বদলির ৬ মাস পর তিনি বিষয়টি জানতে পারেন।
তদন্ত কমিটির পর্যালোচনা : তদন্ত কমিটি তাদের পর্যালোচনায় উল্লেখ করে, ইছহাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মতো এত বিশাল একটি স্থাপনার বার্ষিক মূল্যায়ন ফিল্ড বুক ঘষামাজা করে ২০ কোটি টাকা কমিয়ে রিভিউ বোর্ডে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে কর কর্মকর্তা এবং উপ–কর কর্মকর্তা দায় এড়াতে পারেন না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জয় প্রকাশ সেন ফিল্ডবুকে কাটাছেঁড়া বা ঘষামাজা দেখেও স্বাক্ষর করেছেন। তার দায়িত্ব ছিল ফিল্ড বুকে কাটাছেঁড়া বা ঘষামাজা দেখে স্বাক্ষর না করা। তিনি স্বাক্ষর করে অবমূল্যায়িত মূল্যায়নকে সঠিক মর্মে প্রত্যায়ন করেছেন। সে কারণে আপীল রিভিউ বোর্ড ২৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকার মূল্যায়নকে ৬ কোটি ৩৮ কোটি ১৯ লাখ ২৫০ টাকা মূল্যায়ন ধরে এসেসমেন্ট রিভিউ করেছেন। এছাড়া রিভিউ বোর্ডে হিসাব সহকারির উপস্থিতি না থাকলেও কর–কর্মকর্তা ও উপ–কর কর্মকর্তা আবশ্যিকভাবে উপস্থিত থাকেন। এক্ষেত্রে কর কর্মকর্তা ও উপ–কর কর্মকর্তার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এদিকে প্রতিবেদনের কোথাও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো সুপারিশ করা হয়নি।