মোহাম্মদ সিরাজুল মনির চট্টগ্রাম ব্যুরো
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (চাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’-এর বিপুল জয় অনেকের কাছে বিস্ময়কর, আবার কারও কারও কাছে এটি ছিল ‘সময়ের অনিবার্য’ ফলাফল। শিবিরের এই জয়ের নেপথ্যে কারণ কী? আর কেনই বা দীর্ঘ ঐতিহ্য ও বড় সংগঠন হয়েও এমন ভরাডুবির মুখে পড়লো ছাত্রদল? এই ‘উত্থান-পতনের’ নেপথ্যে কারণগুলো খুঁজে বের করা যাক।
দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাস আশির দশক থেকেই ছাত্রশিবিরের ঐতিহাসিক ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন ক্যাম্পাসে তাদের আধিপত্য খর্ব হলেও চবিতে তারা টিকে ছিল ২০১৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। এরপর হলগুলো হাতছাড়া হলেও শিবিরের নেতাকর্মীরা নানা কৌশলে এই ক্যাম্পাসে টিকে ছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত তাদের কোন কমিটির কথা প্রকাশ্যে আসেনি। তবে গত এক দশকের ‘দুঃসময়েও’ প্রতিবছরই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি করে নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত রেখেছিল। জুলাই বিপ্লবের পর তারা প্রকাশ্যে এসে শিক্ষার্থীবান্ধব একের পর এক কর্মসূচি নিতে থাকে। পাশাপাশি ‘নৈতিক’ আন্দোলনগুলোতেও শিক্ষার্থীদের পক্ষে শিবিরের নেতারা কথা বলার চেষ্টা করেছেন।
অন্যদিকে, জুলাই বিপ্লবের পর ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ইতিবাচক রাজনীতির চেষ্টা করলেও দলে ছিল সমন্বয়হীনতা। পাঁচ নেতা চার ভাগে বিভক্ত বলেও আলোচনা রয়েছে। এছাড়া বিপ্লবের এক বছর পেরিয়ে গেলেও ছাত্রদল নতুন কমিটি কিংবা পুরনো কমিটি- পূর্ণাঙ্গ কোন কমিটিই করতে পারেনি। এতে সুসংবদ্ধ শিবিরের সঙ্গে ছাত্রদলের প্রার্থীদের লড়াই করতে হয়েছে অনেকটাই একাকী।
প্রার্থী বাছাইয়ে ‘ভুল’: চাকসু নির্বাচন নিয়ে আলোচনার শুরু থেকেই ক্যাম্পাসে প্রচার ছিল- ছাত্রদলের কমিটির পাঁচজনের কেউ নির্বাচন করবেন না। ভিপি পদে জালাল সিদ্দিকীই ছাত্রদলের প্রার্থী হচ্ছেন- ১৮ সেপ্টেম্বর প্যানেল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সবাই এটিই ধরে নিয়েছিলেন। এছাড়া চাকসুতে এজিএস পদে নির্বাচিত হওয়া আইয়ুবুর রহমান জিএস পদে এবং জুলাই বিপ্লবে আহত আবদুল্লাহ আল মামুনকে এজিএস পদে প্রার্থী করা হচ্ছে বলেও আলোচনা ছিল।
কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টে যায় শেষ মুহূর্তে। ওইদিন দুপুর ১২টায় প্যানেল ঘোষণার কথা থাকলেও সেই সংবাদ সম্মেলন শুরু হয় দুপুর ২টায়। ছাত্রদলের তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীর অভিযোগ, ছাত্রদল ও বিএনপির কিছু নেতার প্রভাবে এই কয়েক ঘণ্টায় প্রার্থী বদলে যায়।
অন্যদিকে, শিবিরের প্যানেলের প্রধান দুটি পদে প্রার্থী কারা হচ্ছেন- তা নির্বাচনের অনেক আগেই প্রকাশ পায়। নির্বাচনকে ঘিরে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একাধিক সাবেক সভাপতি কৌশল সাজিয়েছেন। নির্বাচনের দিন শিবিরের পক্ষে যখন তাদের সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ভোট প্রার্থনা করেছেন, সেখানে দেখা গেছে- পর্যবেক্ষক হিসেবে ক্যাম্পাসে আসা ছাত্রদলের সাবেকরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে কেউ প্যানেল, কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ভোট চাচ্ছিলেন। এছাড়া শেষ মূহূর্তে একজন নেতাকে বহিষ্কারও ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মাঠনির্ভর ও কৌশলগত প্রচারণা: শিবির প্যানেলের পরিচিতি থেকে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই ছিল সমন্বয়। তারা নেতাকর্মীদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়। প্রতিটি হলে ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে ভোটের দিন পর্যন্ত সংযোগ বজায় রেখেছে। শিবির তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোকে একদিকে যেমন ইতিবাচকভাবে জবাব দিতে চেষ্টা করেছে, তেমনি আবার ‘প্রোপাগান্ডাকে’ দারুণভাবে মোকাবিলাও করেছে। অন্যদিকে, ছাত্রদলের প্রচারণায় একজন প্রার্থীর জন্য যে সমন্বয় থাকা দরকার, সেটির অভাব স্পষ্ট ছিল।
ডাকসু-জাকসু ‘ভাইব’: ডাকসু ও জাকসুতে শিবিরের জয়জয়কারের পর চাকসুতেও এমন কিছু হতে যাচ্ছে- এমন আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে আগেভাগেই। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা ও প্রশাসনিক জটিলতার পর তারা একটি স্থিতিশীল ও সংগঠিত নেতৃত্ব চেয়েছিলেন। এমন একটি নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখতে চেয়েছেন, যারা অন্তত নিজেদের সংগঠনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম। নির্বাচনে নারী ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। শিবির তাদের নারীপ্রার্থীদের মাধ্যমে একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে পেরেছে, যা পূর্বধারণা ভেঙে তাদের প্রতি নারীদের সমর্থন বাড়িয়েছে।
এখন শিবিরের সামনে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ, আর এই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে ছাত্রদলসহ অন্যদের গোছাতে হবে মাঠ। অবশ্য চাকসুতে ছাত্রদলের একমাত্র জয়ী প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান এরইমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাত্রদল মাঠে সরব থাকলেও স্বাধীনভাবে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। ছাত্রদলের কর্মসূচি গুলোতে সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন ধারাবাহিকভাবে প্রতিফলিত হওয়ার কারণে ছাত্রদল মাঠে দাঁড়াতে পারেনি। যার কারণে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে ছাত্রদল যদিও আগামীতে তাদের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল বর্তমান ছাত্রদলের রাজনীতি শান্ত এবং স্বাভাবিক থাকার কারণে কিছুটা মান উন্নয়ন ঘটেছে সংগঠনের যার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারলে আগামীতে সব জায়গায় তাদের ভালো ফলাফল আশা করা যায়।